- সুবাইল বিন আলম
আবারও আমরা চরম গরমের মৌসুমে প্রবেশ করতে যাচ্ছি। এখনই সেটি বেশ টের পাওয়া যাচ্ছে। এসপিএআইয়ের বৈশ্বিক খরা মনিটরিংয়ের একটা ওয়েবসাইট রয়েছে। ওই ওয়েবসাইটে যদি ঢোকেন, বাংলাদেশের অবস্থান দেখলে দেখবেন ‘লাল’ হয়ে আছে। আমাদের আবহাওয়াবিদেরা কি এ নিয়ে পূর্বাভাস দিয়েছেন?
অন্তর্বর্তী সরকারে বন ও পরিবেশ উপদেষ্টা হিসেবে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান দায়িত্ব নেওয়ার পর সবাই বেশ আনন্দিত হয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, এবার নতুন কিছু দেখতে পাবো। হ্যাঁ! আগের অনেক পরিবেশ ‘অবান্ধব’ প্রকল্প বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পরিবেশদূষণে সরকারের দায় কিছুটা কমেছে; কিন্তু পরিবেশ রক্ষায় যথেষ্ট উদ্যোগ এখনো দেখা যাচ্ছে না। হয়তো সামনে আমরা কিছু দেখতে পাব।
জ্বালানি ও বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় বরং এ ক্ষেত্রে বেশ সচেষ্ট। তারা সৌরবিদ্যুৎ নিয়ে অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্রের টেন্ডার করছেন। নতুন নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতিমালার খসড়া করেছে। এ ছাড়া সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার যাতে ভালো মতো হয়, সেই ব্যাপারে তাঁরা চেষ্টা করছেন; কিন্তু সুফল আসতে তো আরও অনেক সময় লাগবে।
ঢাকাসহ সারা দেশে পানির স্তর যে অস্বাভাবিকভাবে নেমে যাচ্ছে, তা রোধে কি কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে? ঢাকায় যেখানে ১৯৯৬ সালে পানির স্তর ২৫ মিটার নিচে ছিল, তা এখন চলে এসেছে ৭৫ মিটারে। একটি শহরের ১৫ শতাংশ জলাশয় থাকা উচিত। আর ঢাকায় আছে মাত্র ২ দশমিক ৯ শতাংশ। পানির স্তর নেমে যাওয়া নিয়ে গুগলে সার্চ করলে এর অনেক খবর পাওয়া যাবে। এটা শুধু সুপেয় পানির অভাবের বিষয় নয়; ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগ হলে দেশকে আরও ভঙ্গুর করে ফেলবে। কোনো চেষ্টা কি করা হচ্ছে ঠেকানোর?
এ দেশে ৫০ বছরে হারিয়ে গেছে ৫২০টি নদী। নদীগুলো উদ্ধারের কোনো চিন্তা কি সরকারের আছে? সরকার তো এখন্র জাতিসংঘের পানিপ্রবাহ কনভেনশনে স্বাক্ষরই করেনি। দায়িত্ব গ্রহণের তিন মাসের মধ্যে সেটি হওয়া দরকার ছিল।
এবার প্রধান উপদেষ্টার চীন সফরে মানুষের বহুল প্রত্যাশিত তিস্তা মহাপরিকল্পনা নিয়ে স্বাক্ষর হয়নি। এদিকে জিয়াউর রহমানের সময়ে পরিকল্পনা করা গঙ্গা ব্যারাজ, ভারতের বাধার জন্য টেন্ডারে যেতে পারেনি, সেটি নিয়েও কোনো কথা হচ্ছে না। এমনকি বিএনপিও যেন সেটি বেমালুম ভুলে গেছে। বাংলাদেশের মতো প্রতিবেশী পাওয়া আসলে যেকোনো দেশের জন্যই সৌভাগ্যের বিষয়। নদী পুনঃখনন এবং খাল উদ্ধারের জন্য মেগা পরিকল্পনাও দেখা যাচ্ছে না। বর্ষাকালে আমরা পানি কীভাবে ধরে রাখব? আমরা জানি, এই সরকারের মেয়াদ বেশি দিন হয়নি। কিন্তু এই সরকার পথ দেখিয়ে গেলে পরের সরকার অনেক কিছু বন্ধ করতে পারবে না।
প্রধান উপদেষ্টা চীনের কাছে ৫০ বছরের জন্য নদী পরিকল্পনা চেয়েছেন; কিন্তু আমাদের ২০১৮ সালে নেদারল্যান্ডসের সহযোগিতায় ডেল্টা পরিকল্পনা ২১০০ এবং ২০২০ সালে জাপানের সহযোগিতায় নদী ম্যানেজমেন্ট প্রজেক্ট পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। তাহলে নতুন করে একই কাজ আবার কেন? প্রধান উপদেষ্টাকে এ তথ্য দেওয়ার দায়িত্ব কার?
গত বছর তীব্র গরমের সময় হাইপ উঠেছিল গাছ লাগানোর। আমরা শুনেছিলাম, তৎকালীন চিফ হিট অফিসার নাকি ৫০ হাজার গাছ লাগিয়েছিলেন। সেই গাছগুলা এখন কোথায় কেউ বলতে পারবেন? গাছ লাগানোর ব্যাপারে সামনের বর্ষার আগেই সমন্বিত পরিকল্পনা দরকার। মানুষ এই সরকারকে সাহায্য করতে প্রস্তুত। উদ্যোগ সরকারকেই নিতে হবে।
বিশ্বে বনভূমি দখলের শীর্ষে আছে বাংলাদেশ। সারা দেশে দখল করা বনভূমি ২ লাখ ৫৭ হাজার একর। এই বনভূমি উদ্ধারে কি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে? এই বনভূমিগুলো উদ্ধার করে গাছ লাগালেই তো দেশ অনেকখানি আগের সৌন্দর্য ফিরে পায়। এদিকে প্রতিবছর আবাদি জমি কমছে ৩৮ হাজার একর করে। ভারতে আবাদি জমি সংরক্ষণ আইন আছে, আমাদের দেশে কেন করা হচ্ছে না?
পরিবেশ উপদেষ্টা বলেছেন, এই দেশের বায়ুদূষণের ৩০ শতাংশের জন্য দায়ী ভারত। এটা গবেষণা দিয়ে প্রমাণিত; কিন্তু বাকি ৭০ শতাংশের জন্য আপনাদের প্রচেষ্টা আমরা দেখতে চাই। ঢাকায় মিথেন গ্যাসের পরিমাণ অত্যধিক বেশি। যার ফলে গরমও বেশি। এর কারণ হিসেবে মাতুয়াইলের ময়লার ডিপোর কথা বলা হয়। এ ছাড়া গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ ২০২১ সালে বণিক বার্তায় প্রকাশিত একটি লেখায় দেখানোর চেষ্টা করেছিলেন—ঢাকায় মিথেন গ্যাস আধিক্যের একটি বড় কারণ হতে পারে গ্যাসের লাইনের লিকেজ। কিন্তু এ ব্যাপারটি এখনো কেউ আমলে নিয়েছেন বলে জানি না।
আমাদের করণীয় কী? আপনারা সবাই ‘থ্রি আর’-এর কথা শুনেছেন (রিডিউস, রিইউজ ও রিসাইকেল)। আমাদের সবার আগে পানির অপচয় কমাতে হবে। বিটিভির ইত্যাদি বহু আগে একটি ক্লিপ বানিয়েছিল— কীভাবে পানির অপচয় কমানো যায়, সে রকম প্রচারণা দরকার। পরিবেশ নিয়ে মিডিয়া প্রচারণা নেই বললেই চলে। এই দেশে ‘গ্রে ওয়াটার রিসাইকেল’ সিস্টেম চলে এসেছে। যার মাধ্যমে খুব অল্প খরচে আমরা বাসাবাড়ির ৮৫ শতাংশ পানি রিসাইকেল করে আবার ব্যবহার করতে পারি। দেশেই উৎপাদিত হচ্ছে এখন। এ ব্যাপারে সরকারের প্রচারণা দরকার। বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের এসি ২৫ ডিগ্রিতে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত ভালো একটি সিদ্ধান্ত।
সারা বিশ্বই অতিরিক্ত তাপপ্রবাহের সমস্যায় ভুগছে। আর আসছে নতুন নতুন টেকনোলজি; কিন্তু আমাদের দেশে মানুষদের মধ্যে এর প্রচারণা নেই। দরকার সরকারি পর্যায়ে প্রচারণা এবং ট্যাক্সের সুবিধা দেওয়া। বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকার একা দাবদাহ ঠেকাতে পারবে না; কিন্তু সবাইকে নিয়ে করার দায়িত্বও সরকারের।
দেশে পরিবেশ প্রকৌশল এবং বিজ্ঞান থেকে পাস করা অনেকে আছেন। তাঁদের ব্যবহার করতে হবে। সরকারি বিশেষজ্ঞের সঙ্গে বেসরকারি খাতের বিশেষজ্ঞ, একাডেমিশিয়ান এবং প্রকৌশলীদের সমন্বয়ে একটি পরিবেশসংক্রান্ত দীর্ঘ পরিকল্পনা প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়নই একমাত্র আমাদের ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করতে পারে।
- সুবাইল বিন আলম টেকসই উন্নয়নবিষয়ক কলামিস্ট।
প্রথম প্রকাশ : প্রথম আলো, ০৮ এপ্রিল ২০২৫