Wednesday, April 23, 2025
Bangladesh Research Analysis and Information Network
Working to Secure Democracy & Liberty
HomeFEATUREDবাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের অর্থায়নের করুণ চিত্র

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের অর্থায়নের করুণ চিত্র

  • ড. তৌফিক জোয়ার্দার

স্বাস্থ্য একটি মানবাধিকার। যে কোনো মানবাধিকারের প্রশ্নে দু’টো পক্ষ থাকে: রাইটস হোল্ডার বা অধিকারের ধারক, যেমন, জনগণ; এবং ডিউটি বিয়ারার বা দায়িত্ব যার ওপর ন্যস্ত, যেমন সরকার। এ কারণে জনগণের স্বাস্থ্যের নিশ্চয়তা বিধান করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এটাকে জনগণের ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক সক্ষমতার ওপর ছেড়ে দিয়ে পার পাওয়া যায়না।

দায়িত্ব পালনের জন্য সরকারকে স্বাস্থ্যখাতে যথেষ্ট অর্থ বরাদ্দ করা লাগে। এটা কেবল মানবাধিকার রক্ষার জন্যই নয়, অর্থনৈতিক কারণেও। একসময় মনে করা হতো, স্বাস্থ্য খাত ব্যয়ের খাত। এখন স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দকে ব্যয় নয় বরং বিনিয়োগ হিসেবে দেখা হয়। স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ মানুষকে সুস্থ রাখে। সুস্থ মানুষের কর্মক্ষমতা বেশি হয়। তাই স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বাড়ালে তা ঘুরে ফিরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কাজেই লাগে।

স্বাস্থ্য খাতে কোন্ দেশ কেমন ব্যয় করছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তার হিসেব রাখে। একে বলে গ্লোবাল হেলথ এক্সপেন্ডিচার ডেটাবেজ। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক এনজিও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এ ডেটাবেজে ১৯০ টি দেশের উপাত্ত বিশ্লেষণ করেছে। সে বিশ্লেষণে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে সরকারি অর্থ বরাদ্দের অত্যন্ত হতাশাজনক চিত্র ফুটে উঠেছে।

বাংলাদেশের উপাত্তের দিকে তাকানোর আগে জেনে নেওয়া যাক স্বাস্থ্য অর্থায়নের কিছু আন্তর্জাতিক মানদন্ড সম্পর্কে। এ মানদন্ড অনুযায়ী একটি দেশের সরকারকে জিডিপির ৫% অথবা বাজেটের ১৫% স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ করতে হয়। ২০২২ সালের উপাত্ত থেকে দেখা যায় বিশ্বের ১৪১ দেশই এ মানদন্ড পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে।

স্বাস্থ্য খাতে সরকার যথেষ্ট অর্থ বরাদ্দ না করলে জনগণকে তার নিজের পকেট থেকে বেশি ব্যয় করতে হয়। এতে অনেক মানুষ স্বাস্থ্য সেবা গ্রহণ থেকে বিরত থাকে অথবা দারিদ্র্য সীমার নিচে নেমে যায়। ফলে তারা খাবার, বাসস্থান এবং শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে আর ব্যয় করতে পারেনা। এভাবে সরকারের স্বাস্থ্য খাতে নিম্ন অর্থ বরাদ্দ একটি মানবাধিকার লঙ্ঘনে পর্যবসিত হয়।

বাংলাদেশের সর্বমোট স্বাস্থ্য ব্যয়ের মাত্র ৬.৫% সরকারী বরাদ্দ থেকে আসে। ১৮.৫% আসে বৈদেশিক বিভিন্ন উৎস থেকে। লজ্জার বিষয় যা দেখা যাচ্ছে তা হলো দেশের সরকার তার জনগণের জন্য যে ব্যয় করে, বিদেশিরা বাংলাদেশের জনগণের জন্য তার প্রায় তিন গুণ বেশি ব্যয় নির্বাহ করে। তার চেয়েও গুরুতর যে চিত্রটি রয়েছে তা হলো, স্বাস্থ্য ব্যয়ের ৭২.৫% আসে সেবা নেওয়ার সময় সরাসরি মানুষের পকেট থেকে। এ জাতীয় ব্যয় স্বাস্থ্য অর্থায়নের বিবেচনায় সবচেয়ে পশ্চাদমুখী ব্যবস্থা যা থেকে উন্নত দেশগুলো বহু আগেই বের হয়ে এসেছে। আমাদের চেয়ে খারাপ অবস্থা পৃথিবীতে একটি দেশেরই আছে, সেটা হলো আফগানিস্তান, যাদের আউট অফ পকেট হেল্থ এক্সপেন্ডিচারের হার ৭৮%। আরও লজ্জার কথা হলো, ইয়েমেনের মতো যুদ্ধবিদ্ধস্ত ও কার্যকর সরকার না থাকা একটি দেশের আউট অফ পকেট এক্সপেন্ডিচারের হারও আমাদের থেকে কম, ৭০.২%।

২০১৯ সাল থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বিভিন্ন দেশের জিডিপির কত শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ করা হয়েছে এবং এ হারে কোনো পরিবর্তন হয়েছে কিনা তাও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ পর্যালোচনা করে। সেখানেও দেখা যায় বাংলাদেশের অবস্থান সবার নিচে। ২০১৯ সালে জিডিপির মাত্র ০.৪% স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ করা হয়েছিল যা ইতোমধ্যেই ছিল বিশ্বের অন্যতম সর্বনিম্ন। ২০২২ সালে তা আরও কমে দাঁড়ায় ০.২%, যা দক্ষিণ সুদান (০.৬%), মিয়ানমার (০.৬%), হাইতি (০.৩%) এবং ইয়েমেনের (০.৩%) মতো দারিদ্যপীড়িত দেশগুলোর চেয়েও কম।

প্রায় একই রকম চিত্র দেখা যায় বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের ক্ষেত্রেও। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান সর্বশেষ নয়, কারণ তার নিচে একটা হলেও দেশ আছে। আর তা হলো আফগানিস্তান। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ ২০১৯ সালের ৩.৩% থেকে কমে ২০২২ সালে হয় ১.২%। এমনকি দক্ষিণ সুদানের মতো সমস্যাসঙ্কুল দেশেও তা ২.১%, মিয়ানমার ও সোমালিয়ায় ২.৫%।

অনেকের মনে হতে পারে, সরকারী স্বাস্থ্য ব্যয়ের এ তুলনা বাংলাদেশের প্রতি অন্যায্য, কারণ এখানে হয়তো বাংলাদেশকে অনেক উন্নত দেশের সাথে তুলনা করা হচ্ছে। এ অভিযোগ খন্ডন করতে চলুন বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের সরকারী ব্যয়কে সমতুল্য অর্থনীতির দেশগুলোর সাথে তুলনা করা যাক। বাংলাদেশ একটি নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ। এমন দেশগুলো গড়ে তাদের মোট স্বাস্থ্য খাতের ব্যয়ের ৪০% সরকারী উৎস থেকে নির্বাহ করে। অথচ বাংলাদেশ সরকার মোট স্বাস্থ্য খাতের ব্যয়ের মাত্র ৭% ব্যয় করে যা নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন।

এ উপাত্তগুলো থেকে স্পষ্ট যে বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতের ব্যয় অত্যন্ত অপ্রতুল। আমরা প্রতিনিয়ত দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে অভিযোগ করি। এ অভিযোগের তীর অনেক সময় স্বাস্থ্য সেবা প্রদানকারী, যেমন ডাক্তার বা নার্সদের ওপরও নিক্ষিপ্ত হয়। অথচ স্বাস্থ্য খাতের বেহাল দশার পেছনে তাদের দায় নিতান্তই নগন্য। এর দায় মূলতঃ আমাদের নীতি নির্ধারকদের যারা মান্ধাতা আমলের মতো স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দকে একটা অপ্রয়োজনীয় খরচ হিসেবে দেখে এসেছেন। অথচ স্বাস্থ্য খাতের ব্যয় যে মূলতঃ একটি লাভজনক বিনিয়োগ তা বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালেই বোঝা যায়। তারা তাদের দেশের মানুষের স্বাস্থ্যের পেছনে ব্যয় করতে কার্পণ্য করেনা। সেসব দেশের মানুষও রাষ্ট্রের জন্য উৎপাদনশীল হয়ে উপযুক্ত বিনিময় দেয়। এভাবে একটা দুষ্টচক্র থেকে বের হয়ে তৈরি হয় একটা পূণ্যচক্র। আমাদের দেশেও স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নের জন্য স্বাস্থ্যনীতি, স্বাস্থ্যব্যবস্থা, ও স্বাস্থ্যঅর্থনীতি বিশেষজ্ঞদেরকে সিদ্ধান্ত প্রণয়নের জায়গাগুলোতে যুক্ত করতে হবে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের অর্থায়নকে নতুন ও আধুনিক চিন্তাধারা ও জ্ঞানের আলোকে ঢেলে সাজাতে হবে। এটা কেবল প্রয়োজনীয়ই নয়, এটা অপরিহার্য।

[হিউম্যান রাইটস ওয়াচের বিস্তারিত রিপোর্টটি পাবেন এই লিঙ্কে: New Data Exposes Global Healthcare Funding Inequalities | Human Rights Watch]

লেখক : এমবিবিএস, এমপিএইচ, ডিআরপিএইচ; সহযোগী অধ্যাপক ও প্রধান, ইমপ্লিমেন্টেশন রিসার্চ অ্যান্ড ইভালুয়েশন ইউনিট, সিঙহেল্থ ডিউক-এনইউএস গ্লোবাল হেলথ ইন্সটিটিউট, ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ সিঙ্গাপুর

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments