- মো. রুবাইয়াৎ সরওয়ার
২০২৪ সালের জুলাইয়ের গণ–অভ্যুত্থান বাংলাদেশকে তার গতিপথ সংশোধন এবং দেশের গণতান্ত্রিক ভিত্তি শক্তিশালী করার একটি সুবর্ণ সুযোগ দিয়েছে। বাংলাদেশের সরকারগুলো কখনোই স্বাধীন জনমত জরিপের ফলাফল গ্রহণে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেনি। তাদের বিশ্বাসের বিপরীত ফলাফল মেনে নেওয়া তাদের পক্ষে অস্বস্তিকর ছিল। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান স্বাধীনভাবে জাতীয় জনমত জরিপ করবে এবং ভয়ভীতিহীনভাবে ফলাফল প্রকাশ করবে, এটা একসময় অকল্পনীয় ছিল। এটিকে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখা হতো।
ইনোভিশন কনসালটিং ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে স্বাধীন জনমত জরিপের সংস্কৃতি গড়ে তোলার সেই অনন্য সুযোগটি দেখেছে। বাংলাদেশসহ আন্তর্জাতিক পরিসরে ১৭ বছরের বৃহৎ পরিসরের সামাজিক গবেষণা ও জরিপের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ ইনোভিশন দেশে প্রথমবারের মতো Bangladeshspeaks.com নামে মাইক্রো-পোলিং সাইট চালু করে এবং ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশে মানুষের নির্বাচনী প্রবণতার ওপর সবচেয়ে বড় জাতীয় জনমত জরিপ পরিচালনা করে।
অন্যদিকে ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স ইন ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) দীর্ঘদিন ধরে শাসনব্যবস্থা সম্পর্কিত নানা বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ জনমত জরিপ পরিচালনা করে আসছে। ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে তারা দুটি রাউন্ডের জনমত জরিপ পরিচালনা করেছে: প্রথমটি ২০২৪ সালের অক্টোবরে এবং সর্বশেষ ২০২৫ সালের আগস্টে।
ইনোভিশন ৬৪টি জেলার ৫৩৬টি প্রাথমিক নমুনা ইউনিটে (পিএসইউ) ১০ হাজার ৬৫৬টি নমুনার ওপর মুখোমুখি সাক্ষাৎকার জরিপ পরিচালনা করে, যেখানে বিআইজিডি তাদের প্যানেলে থাকা পরিবারের ওপর ফোনকল জরিপ পরিচালনা করে। বিআইজিডি তাদের সর্বশেষ জরিপে ৫ হাজার ৪৮৯ জন উত্তরদাতাকে নমুনা হিসেবে গ্রহণ করে। উভয় জরিপই বিভিন্ন দিকের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে; তবে উভয়েরই একটি অভিন্ন প্রশ্ন ছিল—এখনই নির্বাচন হলে আপনি কোন দলকে ভোট দেবেন?
ইনোভিশন কেবল যেসব উত্তরদাতা তাঁদের ভোটের সিদ্ধান্ত প্রকাশ করেছেন এবং যাঁদের সিদ্ধান্ত জানা যায়নি, তাঁদের ফলাফল আলাদাভাবে উপস্থাপন করেছে। অন্যদিকে বিআইজিডি একই সারণিতে সিদ্ধান্ত না নেওয়া, ভোট দেবেন না, জানাতে চাননি এবং প্রকাশিত ভোটদাতাদের তথ্য একত্রে উপস্থাপন করেছে।
ইনোভিশনের মতে, যদি কোনো উত্তরদাতা তাঁর পছন্দ প্রকাশ না করেন, তবে তিনি কার্যত ভোট দেননি। তাই প্রকৃত পরিস্থিতি বোঝাতে প্রকাশিত ভোটারদের তথ্যই সঠিক। অন্যদিকে বিআইজিডির মতে, যেহেতু প্রকাশ না করলেও অনেক ভোটার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন, তাঁদের বাদ দিলে প্রকৃত চিত্র ধরা পড়ে না। উভয় পদ্ধতিরই নিজস্ব সীমাবদ্ধতা রয়েছে। গবেষকেরা এই সীমাবদ্ধতা এবং পরিধির মধ্যে কাজ করেন।
১৭ আগস্ট প্রথম আলো অনলাইনে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মারুফ মল্লিক সাম্প্রতিক জরিপের ফলাফলের ওপর একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল ‘বিএনপি ১৬ শতাংশ, জামায়াত ৩১ শতাংশ—কতটা বিশ্বাসযোগ্য?’ যদিও শিরোনামে দুইটি দলের পরিসংখ্যান ছিল আলাদা আলাদা জরিপের।
এ শিরোনাম থেকে বিভ্রান্তি তৈরি হওয়ার সুযোগ আছে যে, ইনোভিশনের ফেব্রুয়ারির জরিপে জামায়াতের ৩১ দশমিক ৬ শতাংশ (যাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়ে ভোট প্রকাশ করেছেন) ভোটের ফলাফলকে বিআইজিডির অক্টোবরে বিএনপির ১৬ শতাংশ ফলাফলের সঙ্গে মেলানো হয়েছে।
অথচ ইনোভিশনের মোট ১০ হাজার ৬৫৬ নমুনায় হিসাব করলে বিএনপি পায় ১৭ শতাংশ আর জামায়াত ১২ দশমিক ৮ শতাংশ। বিআইজিডির অক্টোবর জরিপে বিএনপি ১৬ শতাংশ ও জামায়াত ১১ শতাংশ পেয়েছিল। অর্থাৎ ফলাফল প্রায় অভিন্ন। বিআইজিডির সর্বশেষ ফোন জরিপে বিএনপি ১২ শতাংশ এবং জামায়াত ১০ দশমিক ৪ শতাংশ পেয়েছে। ইনোভিশনের জরিপে, যারা ভোটের সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন (নমুনা: ৪,৩৫৪), শুধুমাত্র তাদের মধ্যে পর্যালোচনায় বিএনপি পায় ৪১.৭ শতাংশ (৯৫% বিশ্বাসযোগ্যতা স্তর বা কনফিডেন্স লেভেল), ±১.৪৬% ত্রুটিসীমা (মার্জিন অব ইরোর), জামায়াত পায় ৩১.৬ শতাংশ (৯৫% বিশ্বাসযোগ্যতা স্তর, ±১.৩৮% ত্রুটিসীমা) আওয়ামী লীগ পায় ১৩.৯ শতাংশ (৯৫% বিশ্বাসযোগ্যতা স্তর, ±১.০৩% ত্রুটিসীমা), শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে নতুন রাজনৈতিক দল পায় ৫.১ শতাংশ (৯৫% বিশ্বাসযোগ্যতা স্তর, ±০.৬৫% ত্রুটিসীমা)। ইনোভিশনের দ্বিতীয় দফা জরিপ এখনও হয়নি। যদিও পদ্ধতি ভিন্ন, উভয় জরিপের ফলাফলের সামঞ্জস্য মূল জনসংখ্যার কাঠামোর সঙ্গে ফলাফলের মিল এবং ব্যবহৃত পদ্ধতির যৌক্তিকতা ও বিশ্বাসযোগ্যতার প্রমাণ হিসেবে গণ্য করা যায়।
পাঠকদের সুবিধার্থে এখানে তিনটি জরিপের তুলনামূলক বিশ্লেষণ উপস্থাপন করা হলো। এতে দুটি প্রতিষ্ঠানের উপস্থাপনা প্রদর্শিত হয়েছে, একটিতে শুধু যাঁরা ভোটের সিদ্ধান্ত প্রকাশ করেছেন, তাঁদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, আর অন্যটিতে সব নমুনা রাখা হয়েছে, যেখানে সিদ্ধান্তহীন উত্তরদাতারাও অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন।
ইনোভিশনের ফেব্রুয়ারির জরিপে ২৯ দশমিক ৪ শতাংশ ভোটার ছিলেন সিদ্ধান্তহীন এবং ২১ দশমিক ৩ শতাংশ জানিয়েছেন, তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কিন্তু প্রকাশ করবেন না। বিআইজিডির সর্বশেষ জরিপে সিদ্ধান্তহীন ভোটার ছিলেন ৪৮ দশমিক ৫ শতাংশ এবং সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রকাশ না করা ভোটার ছিলেন ১৪ দশমিক ৪ শতাংশ। এই দুই ধরনের ভোটারের প্রোফাইল রাজনৈতিক দলের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইনোভিশনের ফলাফলে সিদ্ধান্তহীন ভোটারদের অন্তর্নিহিত দিকগুলোও বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এ নিয়ে আমি সম্প্রতি ডেইলি স্টার-এ একটি প্রবন্ধ লিখেছি।
কিন্তু মারুফ মাল্লিক তাঁর প্রবন্ধে জরিপগুলোকে পক্ষপাতমূলক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে অভিযোগ করেছেন। তিনি দুই জরিপের পদ্ধতি নিয়ে কোনো বিশদ আলোচনা করেননি। ফোনকল জরিপ আর মুখোমুখি সাক্ষাৎকার জরিপ সরাসরি তুলনীয় নয়—এ বিষয়টিও তিনি এড়িয়ে গেছেন। ইনোভিশনের ৬৪ জেলার ৫৩৬টি প্রাথমিক নমুনা ইউনিটের কোনো বিবরণ না দিয়ে তিনি জার্মানির বন শহরে ধূমপায়ীদের নিয়ে একটি কাল্পনিক জরিপের সঙ্গে তুলনা করেছেন। এতে মনে হতে পারে তাঁর বিশ্লেষণই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
তিনি পূর্বধারণা থেকে মনে করেন বিএনপি, জামায়াত এবং অন্যান্য দলগুলোর ভোটের নির্দিষ্ট শতাংশ থাকা উচিত। আর যখন বিআইজিডি ও ইনোভিশনের ফলাফল তার ধারণার সঙ্গে মেলে না, তখন তিনি জরিপকেই পক্ষপাতমূলক বলেন। এটা বেদনাদায়ক যে মারুফ মল্লিক নিজেই একটি পক্ষপাতমূলক অবস্থান তৈরি করেছেন এবং তারপর ইচ্ছাকৃতভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন যে জরিপগুলো পক্ষপাতমূলক। তিনি তাঁর নিজের বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন মন্তব্য করেছেন, যা তিনি মনে করেন প্রকৃত পরিস্থিতি, কিন্তু এর জন্য কোনো তথ্যভিত্তিক প্রমাণ দেননি। অথচ ভালো গবেষণা সর্বদাই ব্যক্তিগত পক্ষপাত থেকে মুক্ত থাকে। আমি অবাক হতাম, যদি তিনি নিজে একটি জরিপ নকশা করতেন, তবে কি এমন কোনো পদ্ধতি বেছে নিতেন, যা তাঁর নিজের পক্ষপাতকে সমর্থন করে?
২০২৪ সালের জুলাই আমাদের গণতন্ত্র পুনর্গঠনের একটি সুবর্ণ সুযোগ এনে দিয়েছে। আমরা যেকোনো গঠনমূলক সমালোচনা এবং জরিপ পদ্ধতি উন্নত করার পরামর্শকে স্বাগত জানাই।
আমরা বিশ্বাস করি, স্বাধীন জনমত জরিপ সংস্কৃতি গড়ে তোলার আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা বাংলাদেশে টেকসই গণতন্ত্রের জন্য একটি পরীক্ষার ক্ষেত্র হবে। যদি রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা জরিপের তথ্য বিকৃতি এবং ইচ্ছাকৃত ভুল ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেন, তবে ভবিষ্যতের সরকারগুলোও একই কৌশল ব্যবহার করে স্বাধীন জনমত জরিপকে স্তব্ধ করার সুযোগ পাবে। অতীতে যেমন ঘটেছে, তেমনই আবারও কোনো দল তাদের নিজস্ব বর্ণনা চাপিয়ে দিতে পারবে।
আমরা চাই রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা পক্ষপাত থেকে মুক্ত থাকুন এবং গণতন্ত্রের জন্য উপযোগী পরিবেশ গড়ে তুলতে পাশে দাঁড়ান। আমরা চাই আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো ও তাদের নেতারা স্বাধীন জরিপ ও জরিপকারীদের ওপর আস্থা রাখুন। রাজনৈতিক দলগুলো যেন পেশাদারদের সহায়তায় নিজস্ব জরিপ পরিচালনা করে এবং তার ভিত্তিতে নির্বাচনী কৌশল নির্ধারণ করে।
বিশ্বের প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্রগুলো তথ্য ও প্রমাণ দ্বারা পরিচালিত হয়। বাংলাদেশে সেই সংস্কৃতি কখনো গড়ে ওঠেনি। আমরা বিশ্বাস করি, আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা সেই সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করতে সহায়তা করবে। আসুন, আমরা একসঙ্গে কাজ করে যাই সেই স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের জন্য, যার স্বপ্ন আমরা দেখি।
- মো. রুবাইয়াৎ সরওয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ইনোভিশন কনসালটিং
প্রথম প্রকাশ : প্রথম আলো, ১৮ আগস্ট ২০২৫