- তৌফিক জোয়ার্দার
আগে শুনতাম ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ গড়ার জন্য আপামর জনতা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কখনো শুনেছি, “পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর জাতিগত বৈষম্য, শোষণ-শাসন, দমন-পীড়ন ও প্রতিক্রিয়াশীল নীতির বিরুদ্ধে বাংলার কৃষক-শ্রমিক, ছাত্র-জনতা, মুটে-মজুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে তীব্র আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তোলে।” কেউবা বলতেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে দ্বিজাতিতত্বের বিরুদ্ধে গণমানুষের উত্থান। এমনটাও শুনেছি, “মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করেছে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য, যেখানে সব নাগরিকের জন্য রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য নিশ্চিত হবে।” এমন দাবিও বিরল ছিলনা যে ১৯৭২ সালের সংবিধানের মৌলিক নীতিসমসূহ তথা গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদই ছিল মানুষের রক্তদানের মূলমন্ত্র।
কথাগুলো শুনতে ভালো, কিন্তু আমাদের মতো বেয়াড়া কিছু বালক প্রশ্ন না করে পারতনা, ভাই আপনি কি করে জানলেন মানুষ আসলে কী ভেবে বা কোন্ প্রণোদনায় মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল? তারা কি আপনাকে বলে কয়ে বা জিজ্ঞেস করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন? নাকি আপনি নিশ্চিত যে দেড় লাখ মুক্তিযোদ্ধার সবাই একই আদর্শ ও উদ্দেশ্য নিয়ে যুদ্ধে গিয়েছিল?
মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সিংহভাগ ছিল সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ, কৃষক, শ্রমিক, মুটে, মজুর। তারা বৈষম্য, দ্বিজাতিতত্ব, সমাজতন্ত্র—এসব বুঝে, চিন্তা ভাবনা করে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল, এমনটা মনে হয়না। অন্ততঃ গ্রামে গঞ্জে যেসব সাধারণ মানুষ নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধে শামিল হয়েছিলেন, তাঁদের সাথে কথা বলে এমনটা মনে হয়নি। তাঁরা যুদ্ধে গিয়েছিলেন মূলতঃ চোখের সামনে ঘটে যাওয়া অন্যায়ে ক্ষুব্ধ হয়ে, পরিবারের কারও উপর অত্যাচার ঘটেছিল বলে, অথবা জাস্ট দেশের শত্রুকে খতম করবে বলে। সে ধর্মনিরপেক্ষতা বুঝতনা, সমাজতন্ত্র বুঝতনা, খুব সম্ভবতঃ প্রচলিত ধ্যান ধারণার বিপরীতে তাদের অনেকের দাঁড়ি টুপিও ছিল। তারা সবাই উন্নত চরিত্রের অধিকারীও ছিলনা, তার দরকার ছিল এমনটাও বলছিনা। কোনো কোনো এলাকায় বড় ডাকাত দলও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিল।
কাজেই যারা নিজেদের রাজনৈতিক বিশ্বাস বা অবস্থানকে পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধে যোগ দেওয়ার প্রেরণা হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছিলেন, তারা আসলে কেন এমনটা করেছিলেন? তারা মূলতঃ মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাড়ে বন্দুক রেখে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করার চেষ্টা করেছিলেন। এসব ধুরন্ধর নেতাদের অনেকেই সুযোগ ও সামর্থ থাকা সত্ত্বেও নিজেরা মুক্তিযুদ্ধ করেননি। অথচ যুদ্ধের পর সুযোগ বুঝে মুক্তিযুদ্ধের বড় বড় তাত্ত্বিক বনে গিয়েছেন। তার পেছনে আসলে কাজ করেছে তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ ও শঠতা।
২০২৪ এর জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর প্রায় একই রকম একটা প্রবণতা দেখতে পাচ্ছি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার জায়গা দখল করেছে ’জুলাইয়ের চেতনা’। চেতনা শব্দটা পচে যাওয়ায় বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে ‘জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষা’, ’বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষা‘, ‘জুলাইয়ের শপথ’ ইত্যাদি শব্দবন্ধ। এগুলোর পেছনে, অর্থাৎ এই আকাঙ্ক্ষা নিয়ে যারা রাজপথে নেমেছিল, তারা নাকি সুশাসন, জবাবদিহিতা, অন্তর্ভূক্তিমূলক অর্থনীতি সহ নানা রকম চিন্তাভাবনা নিয়ে রাজপথে নেমেছিল।
ভাই একটু থামেন। ঠিক আছে। সুশাসন, জবাবদিহিতা, সংস্কার—এগুলো খুব ভালো। কিন্তু, মানুষ এসব চিন্তাভাবনা করে রাস্তায় নেমেছিল? সিরিয়াসলি? তাহলে এর আগের ১৫ বছর তারা রাস্তায় নামেনি কেন? এসব আকাঙ্ক্ষা কি তবে তখন মানুষের ছিলনা? হঠাৎ করে ২০২৪ সালের জুলাই মাসে কোনো এক ঐন্দ্রজালিক প্রভাবে মানুষের মনে এসব আকাঙ্ক্ষার উদ্ভব হলো আর মানুষ লাখে লাখে রাস্তায় নেমে আসলো? পারেনও ভাই আপনারা।
মানুষ রাস্তায় নেমেছিল প্রথমতঃ একটা ন্যায্য দাবি নিয়ে, চাকরিতে কোটা বাতিল। যখন সাধারণ ছাত্র জনতার ওপর অত্যাচার হলো, মানুষজন আরও ক্ষুব্ধ হলো। দা স্ট্র দ্যাট ব্রোক দা ক্যামেলস ব্যাক যদি কিছু থেকে থাকে তা হলো আবু সাঈদের সেই মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়ানো আইকনিক স্ট্যাচার। যা আমাদের ভেতর থেকে আমাদেরকে অস্তিত্বের শেকড় ধরে নাড়া দিয়েছিল। হয়তো প্রথম বারের মতো আমাদের অনেকের মনে হয়েছিল, এভাবে শান্তিতে কাপুরুষের মতো বেঁচে থাকার চেয়ে আবু সাঈদের মতো মৃত্যুবরণ করাও গৌরবের। আমরা কেউ জামাত-শিবির করতাম, কেউ বিএনপি, কেউ বাম দল, কেউ কোনো দলই না। এমনকি কেউ কেউ আওয়ামী লীগের সমর্থকও ছিল পারিবারিক, ব্যক্তিগত বা এমনকি আদর্শগত কারণে। কিন্তু প্রথম বারের মতো আমাদের মতো ’জীবিত’রা ঈর্ষা করেছিল মৃতদের। ঈর্ষা করেছিল আবু সাঈদ, মুগ্ধদের।
আজকে যারা নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে মৃতদের মুখে কথা বসাচ্ছেন, জীবিত গাজীদের সামনে রেখে আখের গোছানোর ধান্দা করছেন (যেই দলেরই হন), আপনাদের বলি, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যে ধান্দাবাজি হয়েছে, সেরকম ধান্দাবাজি এবারটায় ছাড়ুন। হয় মানুষ মুক্তিযুদ্ধ ব্যবসায়ীদের মতো জুলাই ব্যবসায়ীদেরও আস্তাকুঁড়ে ফেলবে অচিরেই। নয়তো ৭১ থেকে ২০২৪ যেভাবে বাংলাদেশ একটা স্বপ্নের অপমৃত্যু দেখেছে তিলে তিলে, সেভাবেই আরেকটা সম্ভাবনার অপমৃত্যু দেখবে অনাগত কালে।
যারা স্লো বয়লিং ফ্রগের মতো আপনাদেরকে নানা স্বপ্নের উত্তাপে ধীরে ধীরে উত্তপ্ত করছে, তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতন হন। বিপ্লব বা অভ্যুত্থান সংঘটন আর রাষ্ট্র গঠন দুটা সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং অনেকাংশে বিপরীত স্কিলসেট ডিমান্ড করে। আওয়ামী লীগ মানুষকে উত্তেজিত করে, জাগিয়ে, যুদ্ধে নিয়ে যেতে সফল ছিল। কিন্তু দেশ গঠনে সে ছিল একই মাত্রায় অসফল। দেশ গঠন খুবই বোরিং আর আনসেক্সি কাজ, দীর্ঘমেয়াদী, জটিল, অ্যাডাপটিভ। এটা লোক খ্যাপানোর মতো বা রাস্তায় নেমে পড়ার মতো উত্তেজক কাজ না, ঠান্ডা মাথার কাজ।
সমাজকে উত্তপ্ত করা ঠিক হবেনা নতুন বাংলাদেশে। বাস্তবতার নিরিখে অপরিহার্য সংস্কারটুকু করে একটা রেগুলার আনসেক্সি ইকুইলিব্রিয়ামে চলে যাওয়া দরকার অ্যাজ সুন অ্যাস রিজনেবলি পসিবল। যারা এর বিপরীত কথা বলছেন, তাদের মোটিভকে প্রশ্ন করুন, সন্দেহ করুন। কারণ, প্রথমেই তারা একটা মিথ্যা কথা বলেছে। তারা নিজ নিজ চিন্তা, ধারণা বা রাজনৈতিক প্রেমিসকে আমাদের রাজপথের গাজী আর শহীদদের উপর চতুরতার সাথে চাপিয়ে দিয়েছে। এটা যখন তারা করতে পেরেছে, তাদের জাদুকরি থলের ভেতর আরও কিছু থাকতে পারে। সাধু সাবধান।